ইঁদুর নিধনে মাগুরার সফল বীর কৃষক
মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম১ মো: আবদুর রহমান২
বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে দেশ আজ দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দিতে আমাদের প্রতিনিয়ত উৎপাদানের নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কৃষকের কষ্টার্জিত উৎপাদিত ফসলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইঁদুর কেটে-কুটে-খেয়ে নানাভাবে নষ্ট করে। নিজের উৎপাদিত ফসল চোখের সামনে এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে দিশেহারা অবস্থা হয় কৃষকের। ২০০৭ সালে এমনি দিশেহারা হয়েছিলেন মাগুরা সদর উপজেলার মঘী ইউনিয়নের বড়খড়ী গ্রামের কৃষক মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা। পেশায় তিনি একজন ভ্যান/রিক্সা তৈরীকারক। ছোটবেলা থেকে কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে কৃষিকাজের সাথে সরাসরি জড়িত। পেশায় কৃষি কাজের পাশাপাশি ভ্যান/রিক্সা তৈরী ও মেরামতসহ যে কর্মটি ব্রত হিসেবে নিয়েছেন সেটি হলো ইঁদুর নিধন। এ কাজে তিনি ইতোমধ্যে নিজ গ্রাম,ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ইঁদুর নিধন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। তার ইঁদুর নিধনের কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাওয়ায় আঃ হান্নান মোল্যা বলেন, ২০০৭ সালে আমি কিছু জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। উৎপাদিত ধান আমার বাড়ির বারান্দায় ও উঠানে রেখেছিলাম। সপ্তাহখানেকের মধ্যে লক্ষ করলাম ইঁদুরে আমার অধিকাংশ ধান কেটে নষ্ট করেছে। দিশেহারা হয়ে মাগুরা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে যাই। তখন উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব সুব্রত কুমার চক্রবর্তী স্যারের পরামর্শমত ইঁদুর নিধনের কাজে নেমে পড়ি। সে সময়ে ২টি ইঁদুরের লেজে ১ কেজি গম দেয়া হতো। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি ইঁদুর মারার কাজ করে চলেছি।
ইঁদুর নিধনের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রের বিষয়ে হান্নান বলেন, তার একটা ভ্যান/রিক্সা তৈরীর কারখানা আছে। ২০০৭ সালে নিজেই কাঠের তৈরী ৫০০টি ইঁদুর মারার বাক্স তৈরী করেন। প্রথমে তার নিজের গ্রামসহ আশেপাশের ৩৬টি গ্রামে এসব বাক্স নিজে ভ্যান চালিয়ে বিভিন্ন মাঠে রেখে আসতেন। আবার পরদিন সকালে নিজেই ইঁদুরসহ সে সব বাক্সগুলি নিয়ে এসে কাটাখালী বাজারে এনে বাজার কমিটি ও অন্যান্য গন্যমান্য ব্যাক্তি বর্গের সামনে নিধনকৃত ইঁদুরের লেজ পুড়িয়ে ধ্বংস করতেন। এ বিষয়ে তিনি আরো জানান, ইঁদুর মারতে আমি ১১ প্রকার যন্ত্র ব্যবহার করি। এগুলি হলো- ৩ ধরণের কাঠের যন্ত্র, বাঁশ কল, হাড়ি/পাতিল কল, খাঁচা কল, সাচি কল এসব। এছাড়া আমি নিজে ইঁদুর মারার এক ধরণের স্যলুশন তৈরী করেছি। এটি বেগুন আলু ও অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সাথে মিশিয়ে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় চিকন লোহার পেরেকের সাথে গেঁথে রেখে আসি। বৃষ্টি বা কুঁয়াশায় যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য ঢাকনার ব্যবস্থা করি। মাঠের ইঁদুর এগুলি খেয়ে সাথে সাথে মারা যায়। তাছাড়া আমার তৈরীকৃত স্যল্যুশন ড্রামে সংরক্ষণ করি। নিজে ব্যবহার করি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এলাকার কৃষকদের মাঝে বিতরণ করি।
আঃ হান্নান শুধু মাঠের ইঁদুর মেরে ফসল রক্ষা করেন তা নয়, বসত বাড়ির সম্পদ রক্ষার্থেও ইঁদুর নিধন করে থাকেন। এছাড়াও মাগুরা, যশোর এমনকি রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন অফিস/আদালতসহ বিভিন্ন সরকারি - বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেও ইঁদুর নিধনের কাজ করেন। মাগুরা সদরের সাবেক উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সুব্রত কুমার চক্রবর্তীর মাধ্যমে উদ্ভুদ্ব হয়ে এখন পর্যন্ত সম্পদ রক্ষার্থে ইঁদুর নিধনের কাজ করে চলেছেন হান্নান। এ বিষয়ে বর্তমানে উপজেলা কৃষি অফিসার ও কৃষি অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ সবসময়ে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকেন বলে জানান তিনি। কৃষি সম্প্রসারণের অঞ্চল পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইঁদুর নিধনকারী হিসেবে ২০০৮ সালে যশোরে অতিরিক্ত পরিচালক মহোদয়ের নিকট থেকে পুরষ্কার পেয়েছেন। এছাড়া মাগুরার জেলা প্রশাসক মহোদয় ও ডিএই উপপরিচালক মহোদয়ের নিকট থেকেও ইঁদুর নিধনের জন্য পুরষ্কার পেয়েছেন।
হান্নান জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ২০০টি ইঁদুর নিধন করেছেন। ইঁদুর নিধনের বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চাই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল ইঁদুর যাতে নষ্ট করতে না পারে। এজন্য সবাইকে এক যোগে ইঁদুর মারার আহবান জানাই। সেইসাথে আমার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের সকল কৃষক ভাইদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই যাতে তারা সহজেই ইঁদুর নিধন করতে পারেন।
মাগুরা সদর উপজেলাধীন মঘী ইউনিয়নের বড়খড়ী গ্রামের কৃষক আব্দুল হান্নান মোল্যার বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ হুমায়ুন কবীর বলেন, স্বল্প খরচে নিজ উদ্যোগে ইঁদুর নিধনে আত্মনিয়োগ করেছেন হান্নান। তাকে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন কর্মকান্ডে সহয়তা দিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা কৃষি অফিস। হান্নান মাগুরাসহ দেশের গর্ব। ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষায় তার ব্যাক্তি উদ্যোগ দেশের কৃষক সমাজ গ্রহণ করলে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথ আরো সুগম হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ১৯৮৩ সাল থেকে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২১ বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পুরষ্কার দেয়া হবে। জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বছরের ইঁদুর নিধনকারীদের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে ০৫ (পাঁচ) টি ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার প্রদান করা হবে। ইঁদুর নিধন অভিযান-২০২১ এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কার প্রাপ্তদের তালিকা সারণি দ্রষ্টব্য। তালিকা অনুযায়ী মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা কৃষক ক্যাটাগরীতে প্রথম স্থান প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনিসহ জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কার প্রাপ্তদের জানাই অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা ।
লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার,, মোবা: ০১৭১৬-৭৬৮৮২১ ও কৃষি তথ্য কেন্দ্র সংগঠক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা, মোবা: ০১৯৪৩-৫১৭৫০৬, ই-মেইল : khulna@ais.gov.bd